Writer : ডা. কাওসার
ঢামেক, K-65.
আউটডোরে রোগী দেখছি। পাতলা টিঙটিঙে এক লোক হঠাৎ রুমে ঢুকলো। কি সমস্যা জিজ্ঞেস করতেই সে তার হাতদুটো দিয়ে আমার মাথাটা এমনভাবে দলাই মলাই শুরু করলো যে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। ব্যাটা বোধহয় নাপিত, যেভাবে মাসাজ করে ব্যাথার কথা বললো তাতে আমার তাই’ই মনে হলো! আমি আর মানা করলাম না, ভালই লাগছিলো, একটু ঘুম ঘুমও পাচ্ছিলো!
মাথা ব্যাথায় ভোগেনি এমন মানুষ খুব কম পাওয়া যাবে। বিশেষ করে যারা মেডিকেলে পড়ে। আমার নিজেরই এক গল্প বলি। মেডিকেল ফার্স্ট ইয়ারে তখন। কেমন সব কঠিন কঠিন পড়া, কত কিছু মুখস্থ করতে হয়, আর মুখস্থ করাটাই ছিল আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ। বুঝতে গেলে সময় লাগতো বেশি, পড়া আগাতো না। সব মিলিয়ে আমার জীবনে প্রথমবারের মত মাথাব্যাথা শুরু হলো। তখন আমাদের প্রিন্সিপাল বিখ্যাত নিউরোলোজিস্ট প্রফেসর কাজী দীন মোহাম্মদ স্যার। তো একদিন যেয়ে হাজির হলাম কলেজে স্যারের রুমে। স্যার সব শুনে বললেন, relax থাকতে হবে, টেনশন করা যাবে না, মাঠে খেলাধূলা করতে হবে, আর অল্প কিছু ওষুধ দিলেন। Diagnosis ছিল Tension headche। এখনো হয় মাঝে মাঝে, ওষুধ খেতে হয় প্রায়শই!
মাথাব্যাথা মূলত দু ধরণের, Primary (নির্দিষ্ট কোন কারণ নাই), Secondary (নির্দিষ্ট কারণ আছে)। অল্প করে primary headache গুলোই আজ পড়বো, যেগুলো কমবেশি সবারই হয়, প্রচুর রোগী এ রোগের।
Tension type headache
সবচেয়ে কমন। পৃথিবীর সব মানুষই জীবনের কোন না কোন সময়ে এই মাথাব্যাথায় ভুগেছে। টেনশন Depression এর অন্যতম কারণ, তবে এর প্রকৃত কারণ এখনো অজানা। এটি অনেক সময় migraine এর সাথে গোলমাল পাকায়, কারণ কাছাকাছি ক্লিনিক্যাল ফিচার। রোগী এসে বলে পুরো মাথায় চাপ দিয়ে ব্যাথা করে, টাইট ব্যান্ড দিয়ে পুরো মাথায় কেউ বেঁধে রেখেছে এমন। অনেক সময় মাথার দুপাশে (temporal) ব্যাথা হয়, মনে হয় রগদুটো লাফাচ্ছে। ব্যাথা তীব্রতার দিক থেকে dull, তবে কখনো খুব বেশি হতে পারে। যতই বেশি হোক তাতে বমি হয় না, বমি বমি ভাব থাকতে পারে। এই ব্যাথা পুরো মাথা জুড়েই হয়, migraine এ যেমন হয় মাথার একপাশে। এই ব্যাথার সময় আলো অসহ্য (photophobia) লাগে না, migraine এ যেমন লাগে। পুরো মাথায় হলেও ব্যাথার সূত্রপাত অনেক সময় মাথার পিছন (occiput) থেকে হয়। আর ব্যাথা কতক্ষণ থাকবে তার কোন ঠিকঠিকানা নাই, অল্প থেকে সারাদিনও হতে পারে। যেমন ব্যাথার শুরুর পর কোন খুশির খবরে ব্যাথা হঠাৎ কমে যেতে পারে। মাথায় উপর চাপ দিলে বা vertex এর চুল ধরে আস্তে টান দিলেও ব্যাথা (allodynia) বলতে পারে।
চিকিৎসাঃ যেহেতু এর অন্যতম কারণ tension, সেহেতু tension দূর করতে হবে। councelling করতে হবে, এমন রোগী আসলে বলতে হবে, “আপনার রোগ ধরতে পেরেছি, চিন্তার কিছু নাই, যথাযথ চিকিৎসা দিচ্ছি, সুস্থ হয়ে যাবেন।” এতে তার স্ট্রেস কিছুটা কমবে। সাথে বলতে হবে, “exercise করবেন, খেলাধুলা করবেন।” পাশাপাশি ওষুধ হিসেবে low dose এ Amitriptyline (TCA) দেওয়া যায় যা depression tension কমাবে।
Migraine
অল্প বয়সে এটা বেশি হয়। মেডিকেল লাইফে আমার কিছু বন্ধুকে দেখেছি যাদের মাইগ্রেইন আছে। এটা বেশ কষ্টকর। অল্প বয়সে বেশি হয়, ছেলে অপেক্ষা মেয়েদের বেশি হয়, মেয়েদের মাসিকের সময় বেশি হয় যার কারণ হতে পারে তাদের হরমোনজনিত প্রভাব, তাই পিল (oestrogen only) খেলে এটা বাড়তে পারে, দেখা যায় পরিবারের অন্য কারো ছিল বা আছে যেমন মা-খালা। Tension headache এর মত এর কারণও অনেকটাই অজানা, তবে অতিরিক্ত স্ট্রেস এটা বাড়ে। অনেকের মতে এটা হয় cortical নিউরনের ion channels এর গন্ডগোল ফলে, ফলে উল্টা পাল্টা depolairaztion ও repolarization হয়,
এতে Hypothalamus abnormal আচরণ শুরু করে, extracrania vasodilatation করে, শুরু হয় মাথাব্যাথা। আর এই ব্যাথা হয় মাথার একপাশে, অন্যদিকে Tension headache পুরো মাথায় হয়৷ ব্যাথার তীব্রতা এতই বেশি যে বমি হয়, Tension headache এ কিন্তু বমি হয় না। আলো অসহ্য লাগে, Tension headache এ আলো অসহ্য লাগে না। আলো অসহ্য লাগার পাশাপাশি অনেকে চোখে তাঁরা আর জিগজ্যাগ লাইন দেখা শুরু করে (২০%), যাকে বলে Aura এবং এটাকে classical migraine ও বলে। অনেকের (৮০%) এই Aura থাকে না, তখন তাকে বলে common migraine. Aura’র তীব্রতা কখনো এত বেশি হয় যে সাময়িক সময়ের জন্য ন্ধও হয়ে যেতে পারে (scotoma)! যেহেতু আলো সহ্য করতে পারে না, তাই ব্যাথার সময় রোগী অন্ধকার ঘরে চুপচাপ শুয়ে থাকে কারণ নড়াচড়া করলেও ব্যাথা বাড়ে!
চিকিৎসাঃ যখন মাথাব্যাথা শুরু হয়, তখন চিকিৎসা হিসেবে Paracetamol, Aspirin, NSAID (Diclofenac) দেওয়া যায়। এতেও কাজ না হলে Triptans যেমন Sumatriptan, Zolmitriptan দেওয়া যায়। তবে একটু সতর্ক থাকতে হবে৷ এসব ওষুধ dependency তৈরি করে, করতে পারে medication overuse headache. বমি বন্ধ করার জন্য Domperidone দেওয়া হয়। যদি এ ম্যাথাব্যাথা মাঝেমধ্যেই হয়, যেমন প্রতিমাসে দু’বারের বেশি তখন prophylaxis দেওয়া হয়। এই prophylaxis এ বিভিন্ন প্রকার ওষুধ একসাথে থাকে, যেমন- Propanolol (beta blockers), amitriptyline (antidepressant), sodium valproate (antiepileptic)। রোগী নিয়মমাফিক ৩ থেকে ৬ মাস এগুলো খেলে অনেক ভাল থাকে।
Cluster headache (migranious neuralgia)
migraine এর সাথে এর তফাত হল, ওটা যেমন অল্প বয়সে বেশি হয়, এটা হয় একটু বয়সে বাড়লে, যেমন ৩০ বছর বয়সে। migraine যেমন মেয়েদের বেশি হয়, এটা হয় ছেলেদের বেশি। অন্য গুলোর মত এরও তেমন নির্দিষ্ট কোন কারণ জানা যায়নি। তবে PET CT করে দেখা গেছে উপরের ওই migraine এর মত এখানেও hypothalamus কিছুটা Abnormal আচরণ করে। টেনশন করলে যেমন tension headache বেশি হয়, তেমনি ধূমপান আর ড্রিংক করলে cluster headache বেশি হয়। এই ব্যাথা দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে হবে, আজ যখন হবে – কাল ঠিক একই সময়ে হবে, আর তাই একে cluster বলে। এখন ধরুন ব্যাথা রাত ২ টায় শুরু হয়, পরদিন রাত ২ টায় সে ঘুমিয়ে আছে, ঠিকই একই সময় ব্যথা শুরু হবে এবং ঘুম ভেঙে যাবে, তাই একে alarm clock headache ও বলে! tension headache হয় পুরো মাথায়, migraine হয় মাথার একপাশে, আর এই cluster headache হয় যে কোন একটা চোখ ও চোখের চারপাশে, তবে বাম চোখে বেশি। চোখে ব্যাথা এত বেশি হয় যে চোখ লাল হয়ে যায়, চোখ দিয়ে পানি পড়ে, নাক বন্ধ হয়ে যায় (nasal congestion), অনেকটা allergic rhinitis এর মত।
চিকিৎসাঃ এর জন্য আলাদা তেমন কোন চিকিৎসা নাই। চিকিৎসা অনেকটা migraine এর মতই। মাথা ব্যাথা শুরু হলে subcutaneous injection হিসেবে Sumatriptan দেওয়া হয়, সাথে 100% অক্সিজেন থেরাপি। migraine এর prophylaxis গুলো এখানেও prophylaxis হিসেবে দেওয়া যায়, তবে অতটা কার্যকারী না, পাশাপাশি দেওয়া হয় Verapamil (Rate limiting CCB), অল্প কিছুদিনের জন্য oral glucocirticoid ও lithium therapy.
Trigeminal neuralgia
নাম শুনেই বুঝা যায়, সমস্যা ৫ নাম্বার cranial nerve Trigeminal এ। এর তিনটি (Tri) branch আছে, সমস্যা হয় ২য় (maxillary) ও ৩য় (mandibular) branch এ। Migraine হয় অল্প বয়সে, Cluster headache হয় ৩০ এ, আর Trigeminal neuralgia হয় ৫০ এর পর। কারণ হিসেবে যা এই nerve টাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যেমন বয়সজনিত demyelination, হতে পারে multiple sclerosis, বা অন্য কোন lession যা nerve টাকে চাপ দিয়ে ধরে। এই ব্যাথা খুব সামান্য সময়ের জন্য হয়, হয়তো কয়েক সেকেন্ড। অল্প সময় ধরে হয় বলে এর তীব্রতাও বেশি৷ এত বেশি যে মনে হবে সুই দিয়ে কেউ মুখ ফুঁটো করে দিল! মুখের উপর হাত দিয়ে স্পর্শ করলে, ঠান্ডা বাতাস এসে মুখে লাগলে, বা খাওয়ার সময় যখন এই nerve উদ্দিপ্ত হয়, ঠিক তখনই ব্যাথা হতে পারে। এই ব্যাথাটা মাথা থেকে মুখেই বেশি হয় কারণ trigeminal nerver মুখেই supply দেয়। তবে অনেক সময় Trigeminal neuralgia ও Cluster headache একসাথে থাকতে পারে, তখন মুখে ও মাথায় একসাথে ব্যাথা হতে পারে!
চিকিৎসাঃ nerve এর sensitivity কমানোর জন্য carbamazepine দেওয়া হয়। যারা এই ওষুধ সহ্য করতে পারে না, তাদেরকে gabapentin, pregabalin, amitriptyline, glucocorticoid দেওয়া হয়, যারা nerve irritation কমায়। যদি কোন lession nerve টাকে চাপ দিয়ে ধরে রাখে, তবে সেটাকে surgical decompression করলেও এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
Medication overuse headache :
মাথাব্যাথার জন্য ওষুধ খাচ্ছে, খেতে খেতে বেশি দিন খেয়ে ফেললো। আর এখন সেই ওষুধের জন্যই উল্টো আরো বেশি মাথাব্যাথা হচ্ছে। সবার হয় না, কিছু কিছু মানুষের হয়।
চিকিৎসাঃ এমনটা দেখা দিলে চিকিৎসা হল আস্তে আস্তে মাথাব্যাথার ওই ওষুধটা বন্ধ করে দেওয়া। এতে প্রথম প্রথম ব্যাথা আরো বাড়বে, পরে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে, রোগীকে কাউন্সেলিং করতে হয়।
Headache due to specific activities :
ছেলেদের বেশি হয়, ৩০/৪০ বছর বয়সের দিকে। কোন একটা ভারী কাজ করলো, ঠিক তারপরই হঠাৎ মাথাব্যাথা শুরু হলো। শুধুই মাথাব্যাথাই আর কোন symptom নাই, tension headache এর মত পুরো মাথায়ই হতে পারে। বেশিক্ষণ থাকে না, বড়জোর ১০-১৫ মিনিট। এ ব্যাথারও কোন কারণ নাই।
চিকিৎসাঃ এই বয়সে মাথাব্যাথা মানেই stroke বা subarachnoid haemorrhage এর ভয়। ভয় দূর করতে ও কনফার্ম হতে CT scan, CSF study করা হয়৷ যদি দেখা যায় কিছু নাই, তাহলে নিশ্চিত। ব্যাথার সময় সাধারণ paracetamol দেওয়া হয়, আর যদি মাঝেমাঝেই হয় তবে prophylaxis হিসেবে indomethacin বা propanolol ব্যবহার করা হয়।
ম্যাথাব্যাথা নিপাত যাক,
কষ্ট থেকে সব মুক্তি পাক।
Edited By : Nahid Hassan.
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.